প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখে প্রভাত ফেরিতে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি গাওয়ার মধ্যে দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। তবে এই গানটি গাওয়া হয়ে থাকলেও অনেকেই জানতে চান যে এই গানটি সর্ব প্রথমে কবে গাওয়া হয়েছিল। আপনাদের এই প্রশ্নের উপরে নির্ভর করে আমরা এখানে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি প্রথম কবে গাওয়া হয় সেটা জানিয়ে দেবো। সেই সাথে এই গানটি গাওয়ার কারণ অথবা এই গান গাওয়ার পেছনের ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব যাতে করে আপনারা নিজেদের ভেতরের ধারণাগুলো স্পষ্ট করে নিতে পারেন।
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি”এই লাইনের মাধ্যমে যদি আমরা কিছু বোঝার চেষ্টা করি তাহলে দেখব যে এখানে একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখ আমাদের ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গায়িত করা হয়েছিল। আর এটা এমন একটা ঐতিহাসিক ঘটনা যেটা কখনোই ভুলার নয় অথবা পৃথিবীর ইতিহাসে এমনভাবে ভাষার জন্য কোন ভাই রক্ত দেননি। পৃথিবীর বুকের বিভিন্ন ধরনের ইতিহাস অথবা বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আন্তর্জাতিক দিবস পালন করে থাকলেও বাঙালি জাতির এই ভাষা দিবস সারা পৃথিবীব্যাপী পালন করা হয়ে থাকে।
কারণ ভাষার জন্য এবং মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখার জন্য পৃথিবীর বুকে বাঙালি জাতীরাই বুকের রক্ত দিতে দ্বিধাবোধ করেনি। ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তানী সরকার আমাদের দেশের শাসনভার গ্রহণ করে তখন থেকে তারা ভাষাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করছিল এবং উর্দু ভাষাকে আমাদের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু যেখানে আমরা মাতৃভাষা বাংলাই কথা বলে অভ্যস্ত অথবা মনের ভাবগুলো প্রকাশ করার ক্ষেত্রে মাতৃভাষা ব্যবহার করে সেখানে অফিশিয়াল ভাবে নাকি আমাদেরকে উর্দু ভাষা ব্যবহার করতে হবে।
পাকিস্তানি সরকার আমাদের প্রতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে শোষণ ও শাসন চালালেও সর্বপ্রথমে ভাষার প্রতি আঘাত হানে। কিন্তু বাঙালি জাতি নরম প্রকৃতির হয়ে থাকলেও সত্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে অথবা নায্য বিষয়গুলো অধিকার করার লক্ষ্যে কখনোই মাথা নোয়াবার ছিল না। তাদের কাছে মনে হয়েছে মাতৃভাষা বাংলাকে এভাবে বাদ দিয়ে কখনো একটা জাতি বেঁচে থাকতে পারে না। তাই যখন থেকে ভাষার বিষয়ে প্রসঙ্গ উঠে আসে তখন থেকে বাঙ্গালী জাতির ভিতরে এক গুঞ্জন সৃষ্টি হয় এবং বাংলা ভাষাকেই তারা মাতৃভাষা হিসেবে রাখতে চাই।
এভাবে ঘটনা গুলো পর্যায়ক্রমে চলতে থাকে এবং ১৯৫২ সালে এই ঘটনা তুমুল আকার ধারণ করে। অর্থাৎ এই সময়ে সঠিকভাবে আমাদেরকে এই ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে থাকলেও আমরা কখনোই তা মেনে নিইনি এবং এর জন্য 144 ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে মিছিল বের করার জন্য পুলিশ ছাত্র-জনতা এবং ঢাকার বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের উপরে গুলি বর্ষন করে। ভাষা আন্দোলনের এই প্রেক্ষিতে অনেকজন শহীদ হন এবং তারাই আমাদের কাছে ভাষা শহীদ নামে পরিচিত।
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো এই বিষয়গুলোর মধ্য দিয়ে আমরা বাংলা ভাষাকে পরবর্তীতে মাতৃভাষা হিসেবে পেয়েছি। কিন্তু ভাষার জন্য এই জীবন দেওয়াকে কেন্দ্র করে সাংবাদিক ও লেখক আব্দুল গাফফার চৌধুরী ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে এই গানটি রচনা করেছিলেন। তবে প্রথম কবে গাওয়া হয় সে প্রসঙ্গে যদি আপনারা জানতে চান তাহলে বলবো যে ১৯৫৪ সালের প্রথম যেবার প্রভাত ফেরি বের করা হয় সেইবার এই গানটি প্রথম গাওয়া হয়েছিল।
আলতাফ মাহমুদের সুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানটি গাওয়া হয় এবং এটাই পরবর্তীতে প্রাতিষ্ঠানিক সুর হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কারণে আমরা এখন পর্যন্ত সেই সুর ব্যবহার করে আসছি। তাছাড়া ১৯৬৯ সালে জহির রায়হান যখন তার চলচ্চিত্র “জীবন থেকে নেওয়া” বের করেন তখন এই চলচ্চিত্রে গানটি ব্যবহার করা হয়েছিল। তাই ভাষার অপপ্রয়োগ অথবা অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে আমরা কেউ ভাষাকে অসম্মান করব না। কারণ যে ভাষার জন্য আমাদের ভাইয়েরা বুকের রক্ত বিলি করে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি সেই ভাষাকে অসম্মান করার কোন সাহস আমাদের থাকতে পারেনা।